ঝিনাইদহ-১ আসনের প্রাক্তন সাংসদ আনোয়ারুল আজিম বাংলাদেশে মামলার তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার মামলাটি তদন্ত করছিল। ২৫ মে সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তৎকালীন সাংসদ আনোয়ারুল গত বছরের ১২ মে ভারতে নিখোঁজ হন। ৭ মে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিউটাউনের একটি ফ্ল্যাটে তাকে খুন করা হয়।
এই ঘটনায় ভারতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। অন্যদিকে, আনোয়ারুলের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস গত বছরের ২২ মে শ্রীবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটি খাল থেকে নিউটাউনের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাঙ্ক এবং কয়েকটি মাংসের টুকরো, হাড় উদ্ধার করা হয়। আনোয়ারুলের দেহের অংশ কিনা তা নিশ্চিত করতে গত বছরের নভেম্বরে তার মেয়ে মুমতারিন কলকাতায় গিয়েছিলেন। তিনি ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।
পরে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, ডিএনএ পেয়েছে। দেহের টুকরোগুলো আনোয়ারুলের। তবে বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থা এখনও কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ডিএনএ রিপোর্ট পায়নি।
তদন্তকারী সূত্র বলছে, গত বছরের ৭ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলার তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে মামলার বাদীর সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ফলে তথ্য আদান-প্রদান সহ বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে এখন মামলাটি তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
গ্রেফতার ৯
আনোয়ারুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই দেশে মোট ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন ভারতে, সাতজন বাংলাদেশে।
তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় জেলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া জিহাদ হাওলাদার এবং সিয়াম হোসেন। বাংলাদেশের এক সময়ের চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাগ্নে তানভীর ভূঁইয়া, সহযোগী শিল্পি রহমান, মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং ফয়সাল আলী, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম, একই কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া সাইদুল ছাড়া আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ডিবি তদন্তের সময় আনোয়ারুলের বন্ধু আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীনকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে। তদন্ত সূত্র বলছে, শিমুল ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল।
রহস্যজট
আনোয়ারুল হত্যার পর দুই দেশের তদন্তে সোনা পাচার নিয়ে বিরোধের বিষয়টি উঠে আসে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন তদন্ত সংস্থা ডিএমপি ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি সামনে আনেনি।
কিন্তু তদন্তের অগ্রগতি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদনসহ, অভ্যন্তরীণ আলোচনায় তৎকালীন তদন্তকারীরা বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।
হত্যার আলোচ্য বিষয়ের পর ঝিনাইদহের প্রথম আলো আনোয়ারুলের সোনা পাচার দ্বন্দ্বের তদন্তে উঠে আসে। এমনকি খুনের মামলায় দেশে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজনেরও ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে সোনা পাচারের বিষয়টি জানা গেছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কর্মকর্তারাও জানতে পেরেছেন যে আনোয়ারুল সোনা পাচারের সাথে জড়িত ছিলেন। তবে রাজ্য পুলিশের প্রাথমিক চার্জশিটে ঠিক কী উদ্দেশ্যে আনোয়ারুলকে হত্যা করা হয়েছিল তা বলা হয়নি।
বাংলাদেশে মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি পরিদর্শক খান মো. এরফান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে আনওয়ারুলকে হত্যা করা হয়েছে, এটা নিশ্চিত হয়েছি। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি সোনা পাচার করছে নাকি অন্য কিছু, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
পরিবারের ক্ষোভ
এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও তদন্তের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আনোয়ারুলের পরিবার। তবে কোনও পরিবার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে রাজি হয়নি।
আক্তারুজ্জামানের ফিরে আসার উদ্যোগ নেই
তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, কলকাতায় আনোয়ারুলকে যে ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেছিলেন আখতারুজ্জামান। খুনের ছকের আগেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইটে নেপালের কাঠমান্ডু, নয়াদিল্লিতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে একটি বাসা আছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
কিন্তু তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত আখতারুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ডিবি এবং সিআইডি কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উল্লেখযোগ্য কোনও চুক্তি নেই। এ কারণেই আক্তারুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমে ইন্টারপোলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বেশিদূর এগোয়নি। এই মুহূর্তে, আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে কোথায় আছেন সে সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে তথ্য নেই।